জাফলং(Jaflong) | The Daughter of Nature
জাফলং (Jaflong) প্রকৃতি কন্যা নামে খ্যাত বাংলাদেশের সুপ্রাচীন পর্যটন কেন্দ্র । সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি অহংকারের নাম জাফলং (Jaflong)। সিলেট শহর থেকে জাফলং (Jaflong) এর দুরত্ব ৬২ কিলোমিটার।
ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে জৈন্তা-খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত । এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব মিলন মেলা । তাই বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটন শিল্প অথবা সম্পদ হিসেবে পরিচিত ।
জাফলং (Jaflong) -এর ইতিহাসঃ
ঐতিহাসিকদের মতে বহু হাজার বছর ধরে জাফলং (Jaflong) ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে । ছিল থাকা এক নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ খৃস্টাব্দে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির পর এবং খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলে বেশ কয়েক বছর জাফলং (Jaflong) এর বিস্তীর্ণ এলাকা পতিত হয়ে পড়েছিল।
পরবর্তিতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধান শুরু করে এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং (Jaflong) আসতে শুরু করে । তাই পাথর বাবসার প্রসার ঘটতে থাকে আর একসময় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি।
উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল জাফলংয়ের সীমান্তের ওপারে । মানে ভারতের ডাউকিতে। ১৩ জুলাই ১৯৭১ ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের একটি সশস্ত্র দল জাফলং এ ঢোকে ।
পিয়াইন নদীর ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে ছিল একদল পাকিস্তানি সেনা । উভয় পক্ষের মধ্যে দুই দফা যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানী বাহিনীর ৫ সেনা নিহত হলে পাকিস্তানিরা পলিয়ে যায়।
একই সময় দুজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। এছাড়া জাফলং (Jaflong)য়ের পাশে সারি নদীতেও বড় আকারের যুদ্ধ হয়। আর এভাবেই শক্রমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পায় জাফলং
জাফলং (Jaflong) -এর বিবরণঃ
বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত-বর্তী এলাকা জাফলং (Jaflong)। অপর পাশে ভারতের ডাওকি। ডাওকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাওকি নদী জাফলং হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মূলতঃ পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং এর অবস্থান। জাফল এ পাওয়া যায় কঠিন শিলার নুড়ি। একারণে সিলেট এলাকার নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়, এলাকার মানুষের এক বৃহৎ অংশের জীবিকা গড়ে উঠেছে এই পাথর উত্তোলন ও তা প্রক্রিয়াজাতকরণকে ঘিরে।
জাফলং (Jaflong)-এ পাথর ছাড়াও পাওয়া গেছে সাদামাটি বা চীনামাটিও, যদিও সেখানে মাটি বা বালি পরিশোধন করার মতো কোনো অবকাঠামো নেই। এই এলাকায় যেমন সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করেন, তেমনি বাস করেন উপজাতিরাও। জাফলং এর বল্লা, সংগ্ামপুজি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুষ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে ৫টি খাসিয়াপু্জী। আদমশ্ুমারী অনুযায়ী জাফলং-এ ১,৯৫৩ জন খাসিয়া উপজাতি বাস করেন ।
জাফলং জিরো পয়েন্টে রয়েছে তামাবিল স্থল বন্দর, এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারতের সাথে পণ্য আমদানি রপ্তানী হয় । কয়লা আমদানির জন্য বাংলাদেশের অন্যতম স্থল বন্দর হচ্ছে জাফলং তামাবিল ।
দর্শনীয় বিষয়বন্তঃ
জাফলং (Jaflong) এ ভ্রমনে উদ্দেশ্যে বের হলেই সিলেট তামাবিল হাইওয়ে ধরে জাফলং পৌছানো পর্যন্ত চোখে পড়বে মেঘালয় পাহাড়ের সাপের ন্যায় আকাবাকা দৈহিক গড়ন।
জাফলং (Jaflong)-যেহেতু সীমান্তবর্তী এলাক তাই বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়ালে চোখে পড়ে ভারত সীমান্ত-অভ্যন্তরে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড়শ্রেণী । এসব পাহাড় থেকে নেমে আসে ঝর্না এবং তা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষনের কেন্দ্র বিন্দু । আরেকটি প্রধান আকর্ষন হলো ডাউকির ঝুলন্ত ব্রিজ। জিরো পয়েন্টে দাড়ালে ভারতের ডাউকি অঞ্চলের হ্যাঙ্গিং ব্রিজ বা ঝুলন্ত সেতু পর্যটকদের আকৃষ্ট না করে পারেনা
মেঘালয় পাহাড়ের ঝর্নাধারার স্বচ্ছ পানি ডাউকি নদি হয়ে সরাসরি এসে থাকে জাফলং নদীতে । সর্পিলাকারে ডাউকি নদি এবং স্বচ্ছ পানি পর্যটকদের বিমোহিত করে । পানির স্বচ্ছতা এমন যা নদীর গভীরস্ত শ্যাওলার কমর দুলানো খালি চোখে ধরা পড়ে।
শীতের উষ্ণতায় নদী আর প্রকৃতি যখন শুকিয়ে যায় তখন হঠাত করে মেঘালয় পাহাড়ের উপর ধেয়ে আসা মৌসুমী ঝড় ঝর্নার কান্না হয়ে এসে পড়ে জাফলং নদীতে । কখনওবা জাফলং নদী বয়ে চলে উলটা স্রোতে । ভাগ্যবান পর্যটকদের অবিশ্বাস্য কিছু অনুভূতির সঞ্চার করে ।
পহেলা বৈশাখে মনেহয় যেন এ এক মানুষের মিলন মেলা । ১লা বৈশাখে মানে বাংলা নববর্ষে করা হয় মেলার আয়োজন, এই মেলাকে ঘিরে উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা । বর্ষা আর শীতকালে জাফলং এর আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বর্ষাকালে বৃষ্টিন্নাত গাছগাছালি আর খরস্রোতা নদী হয় দেখার মতো। তাছাড়া পাহাড়ের মাথায় মেঘের দৃশ্যও যথেষ্ট মনোরম।
জীববৈচিত্রঃ
জাফলং (Jaflong) অঞ্চলের উত্ভিদ প্রজাতির মধ্যে খাটো জাতের মধ্যে পাম গাছ দেখা যায়। জাফলং (Jaflong)-এ নারিকেল আর সুপারি গাছে বাস করে প্রচুর বাদুড়। এছাড়া জাফলং (Jaflong) বাজার কিংবা জাফলং (Jaflong) জমিদার বাড়িতে আবাস করেছে বাদুড় । যদিও খাদ্যসংকট, আর মানুষের উৎপাতে, কিংবা অবাধ বৃক্ষনিধনে অনেক বাদুড় জাফলং ছেড়ে চলে যাচ্ছে জৈন্তিয়া আর গোয়াইনঘাটের বেঁচে থাকা বনাঞ্চলে, কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে।
পবিবেশ বিপর্যয়ঃ
জাফলং (Jaflong)-এর পাথর শিল্প একদিকে যেমন এ এলাকাকে সকল অঞ্চলের কাছে পরিচিত করেছে, তেমনি এই পাথর শিল্পের যথেচ্ছ বিস্তারে এলাকার বাতাস হয়ে পড়েছে কলুষিত। যন্ত্রের সহায়তায় উন্মুক্ত উপায়ে পাথর ভাঙার কারণে ভাঙা পাথরের গুড়া আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে আর সাধারণ্যের শ্বাস-প্রশ্বাসকে ব্যাহত করছে।
সরকারি অনুমোদন উপেক্ষা করে নদিতে ৩০-৪০ ফুট গর্ত করে প্রতিনিয়ত উত্তোলন করা হচ্ছে পাথর। এতে করে নদীর অববাহিকা হচ্ছে ক্ষতির সম্মুখীন । জীববৈচিত্র আর উদ্ভিদ বৈচিত্র ক্রমাগত হয়ে পড়তেছে হুমকির সম্মুখীন। অবাধে কাছ কেটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নষ্ট হবার সাথে সাথে বাড়তেছে রোগ বালাইয়ের প্রকোপ ।
উজান থেকে নেমে আসা পাথর আর বালু তে পিইয়াইন নদী ভরে যাওয়ায় নদির গভীরতা কমেছে, ফলে বর্ষাকালে মৌসুমি ঢলে খতিগ্রস্থ হয় নিকটবর্তী এলাকা। ব্যাহত হয় জীবন জীবিকা। ১৯৮৮ সালে ডাউকি নদীর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বি,ডি,আর ক্যাম্প সহ বিভিন্ন এলাকা লন্ড-ভন্ড হয়। ২০০৯ সালের ২০ মে আবারও সে ঢলেরি পুনরাবৃত্তি ঘটে এবং চা-বাগান সহ এলাকার অনেক ক্ষতি হয়।
যাতায়াত ব্যবস্থা
১৯৮০ -এর দিকে সিলেটের সাথে জাফলং এর ৫৫ কিলোমিটার সড়ক তৈরি হওয়ার মাধ্যমে দেশের অন্যান্য সকল অঞ্চল থেকে এই এলাকার সাথে সড়ক-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সড়কপথে সিলেট সদর থেকে এই স্থানের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে সিলেটে যেভাবেই আসুন বাস অথবা ট্রেনে স্টেশন থেকে নেমে ডান বামে তাকালেই দেখতে পাবেন সিলেট-তামাবিল গামী বাস, মাইক্রো, অথবা প্রাইভেট কার, সি এন জি । লকাল বাসে ১০০ টাকার ভেতরেই ভাড়া প্রদান করে আপনি এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌছাতে পারবেন জাফলং।