Madhabkunda waterfall Description
প্রকৃতির অপরূপ লীলা নিকেতন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলপ্রপাত মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) জলপ্রপাত।
এটি দেখতে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন অনেক লোকের সমাগম ঘটে এখানে। প্রায় 162 ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশি এর গা বেয়ে অবিরাম ধারায় সাঁ সাঁ শব্দে নিচে পড়ছে। অবিরাম পতনের ফলে নিচে সৃষ্টি হয়েছে কুণ্ডের। আর কুণ্ডের প্রবাহমান স্রোতধারা শান্তির বারিধারার মতো মাধবছড়া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) এর নামকরনের ইতিহাসঃ
মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) এর নামকরণ সম্পর্কে কথিত আছে যে, শ্রীহট্টের রাজা গঙ্গাধ্বজ ওরফে গোবর্ধন পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে সেখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় মাটির নিচে একজন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। তখন তিনি ওই সন্ন্যাসীর পদবন্দনা ও স্তূতি করলে সন্ন্যাসী তাকে নানা উপদেশসহ মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশ তিথিতে তাকে এ কুণ্ডে বিসর্জন দিতে নির্দেশ দেন। সন্ন্যাসী বিসর্জিত হওয়া মাত্র তিনবার মাধব, মাধব মাধব নামে দৈববাণী হয়। সম্ভবত এ থেকেই মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) নামের উৎপত্তি। আবার কারও কারও মতে, মহাদেব বা শিবের পূর্বনাম মাধব এবং এর নামানুসারে তার আবির্ভাব স্থানের নাম মাধবকুণ্ড। এ কুণ্ডের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে শিবমন্দির।
যে পাহাড়টির গা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে এ পাহাড়টি সম্পূর্ণ পাথরের। এর বৃহৎ অংশজুড়ে রয়েছে ছড়া। ছড়ার উপরের অংশের নাম গঙ্গামারা ছড়া আর নিচের অংশের নাম মাধবছড়া। পাহাড়ের উপর থেকে পাথরের ওপর দিয়ে ছুটে আসা পানির স্রোত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে হঠাৎ খাড়াভাবে উঁচু পাহাড় থেকে একেবারে নিচে পড়ে যায়। এতে দুটি ধারা সৃষ্টি হয়। একটি বড়, একটি ছোট। বর্ষাকালে ধারা দুটি মিশে যায়। জলরাশি যেখানে পড়ছে তার চতুর্দিকে পাহাড়, নিচে কুণ্ড। কুণ্ডের মধ্যভাগে অনবরত পানি পড়ছে। এই স্থান অনেক গভীর। কুণ্ডের ডান পাশে একটি পাথরের গহ্বর বা গুহার সৃষ্টি হয়েছে।
মাধব কুন্ডের প্রকৃতিঃ
১৩৪২ সালে বিষ্ণুদাস সন্ন্যাসী মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) এর পশ্চিমাংশে কমলা বাগান তৈরি করেন, সেই কমলা বাগান আজও আছে। মূল জলপ্রপাতের বাম পাশে প্রায় ২০০ গজ দূরে আরও একটি পরিকুণ্ড নামের জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। সেখান থেকেও অনবরত পানি পড়ছে। কিন্তু সেখানে খুব কষ্ট করে যেতে হয়। যাতায়াতের সুবিধা করে দিলে সেটি দেখতেও অনেকেই ভিড় করবে।
মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) ইকোপার্ক এলাকায় এককালে কমলা বাগান ছিল; ছিলো আম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, সুপারি ও পানের বাগান। এখানে ফলতো লেবুসহ অন্যান্য ফলমূল। এছাড়া ছিল বিভিন্ন প্রকার বনজ গাছপালা। কিন্তু বর্তমানে এর অধিকাংশই অতীত। “ সামাজিক বনায়ন ” -এর নামে প্রাকৃতিক গাছপালা কেটে ফেলে রোপন করা হয়েছে বিভিন্ন হাইব্রিডজাতীয় গাছপালা, যেমন: একাশিয়া (স্থানীয় নাম আকাশি) । ঔষধি ও অর্থকরি গাছ আগরও আছে রোপন তালিকায়। কিন্তু প্রাকৃতিক বন নষ্ট করে এই সামাজিক বনায়ন শ্রেফ পরিবেশ ধ্বংসই করেছে বেশি।
মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) জলপ্রপাত, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাত হিসেবে সমধিক পরিচিত। পাথারিয়া পাহাড় (পূর্বনাম: আদম আইল পাহাড়) কঠিন পাথরে গঠিত; এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। এই ছড়া মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) জলপ্রপাত হয়ে নিচে পড়ে হয়েছে মাধবছড়া। অর্থাৎ গঙ্গামারা ছড়া হয়ে বয়ে আসা জলধারা প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু থেকে নিচে পড়ে মাধবছড়া হয়ে প্রবহমান।
সাধারণত একটি মূল ধারায় পানি সব সময়ই পড়তে থাকে, বর্ষাকাল এলে মূল ধারার পাশেই আরেকটা ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে। জলের এই বিপুল ধারা পড়তে পড়তে নিচে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট কুণ্ডের। এই মাধবছড়ার পানি পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হতে হতে গিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে।
বর্তমানের মাধব কুন্ড
কিছু বছর আগেও মাধবকুন্ড (Madhabkunda waterfall) ছিল বাংলাদেশের জলপ্রপাত প্রেমী পর্যটকদের কাছে একমাত্র আকর্ষন। বর্তমানে বাংলাদেশে আরো বেশ কিছু ঝর্ণা আবিষ্কৃত হয়েছে। তবু পর্যটকদের কাছে মাধবকুন্ড (Madhabkunda waterfall) ঝর্ণার আবেদন একটুও কমেনি তাই সরকারী উদ্যোগে এখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্টহাউজ ও রেস্টুরেন্ট আর সম্পূর্ন এলাকাকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে মাধবকুন্ড ইকোপার্ক। অনিন্দ্য সুন্দর এ জলপ্রপাত প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু আর মাধবকুন্ড ঝর্ণা থেকে ১৫-২০ মিনিট হাটলে পরিকুন্ড ঝর্ণা নামে আরেকটি ঝর্ণা চোখে পড়ে। এছাড়া এখানে আছে দিগন্তজোড়া চা বাগান, খাসিয়া পল্লী, কমলা, লেবু, সুপারী ও পানের বাগান আবার কোথাও কোথাও জুম চাষেরও দেখা মিলবে।
মাধবকুন্ড ও ইকোপার্কঃ
মাধব কুন্ড (Madhabkunda waterfall) জলপ্রপাত ছাড়াও এই ইকোপার্কে রয়েছে আরেকটি জলপ্রপাত, যা মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে অনতিদূরে অবস্থিত। শিবমন্দির-এর বিপরীত দিকের ছড়া ধরে গেলে এই জলপ্রপাতের দেখা পাওয়া যায়। এই জলপ্রপাতটি পরীকুণ্ড জলপ্রপাত নামে পরিচিত। তবে এই জলপ্রপাতটি কেবল বর্ষাকালেই প্রাণ ফিরে পায়। কথিত আছে, পুরাকালে গৌরী দেহান্তরিত হলে মহাদেব (মাধবেশ্বর) প্রিয়াবিরহে ব্যথাকাতর মনে প্রিয়ার নিষ্প্রাণ দেহ কাঁধে নিয়ে অনির্দিষ্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এই যাত্রায় গৌরীর দেহের অংশ যেখানে যেখানে পড়েছে, সেখানে সৃষ্টি হয়েছে তীর্থক্ষেত্রের। আর পাথারিয়ার গভীর অরণ্যে গৌরীর একটা অংশ পড়েছে বলে দাবি করা হয়, যার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মিলেনি।